নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ

আনিকা আহাম্মেদ । ২৬ এপ্রিল, ২০২০


নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ

নারীর ক্ষমতায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নারীরা তাদের পূর্বের অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের যোগ্যতা ও অর্জনকে তুলে ধরতে পারেন এবং পরিবার, সমাজ বা গণজীবনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের সিদ্ধান্ত ও অবস্থানকে তুলে ধরেন। নারীর ক্ষমতায়ন মূলত অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এবং রাজনৈতিক অবকাঠামোতে অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি মাধ্যম বা উপায়, যার মাধ্যমে নারীরা নিজেদের মেধা ও যোগ্যতাকে প্রকাশ করতে পারেন এবং নিজেদের অধিকারগুলো আদায়ে সচেষ্ট হতে পারেন। নারীর ক্ষমতায়ন তখনই সম্ভব, যখন কোনও বাধা বা সীমাবদ্ধতা ছাড়াই নারীরা শিক্ষা, কর্মজীবন এবং নিজেদের জীবনধারায় পরিবর্তন আনার জন্য বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধাগুলো ব্যবহারের সুযোগ পান। নারীর ক্ষমতায়নই হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা ও সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম চাবিকাঠি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি নারীদের ক্ষমতায়নের পথিকৃৎ। ১৯৬৭ সালে মহিলা লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নারীদের মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সব পর্যায়ে নারীদের সম অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয় এবং নারী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিশেষ বিধান প্রণয়নের ক্ষমতাও সংযোজন করা হয় (অনুচ্ছেদ ২৭ ও ২৮)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ অনুসরণ করেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরপরই সব পর্যায়ে লিঙ্গ সমতা, নারীর উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য অসংখ্য নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করেন এবং বাস্তবিক অর্থে সব পর্যায়ে তা সুসংহত ও কার্যকর করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন।


বাংলাদেশে ইন্টারনেট প্রবেশের হার প্রায় ৩৬%। এর জন্য প্রায় ৬৪% নাগরিক এখনও ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করছেন না এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সম্পর্কে জানেন না। সে কারণে তারা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং চ্যানেলগুলিতে উপলব্ধ সুবিধাগুলি উপভোগ করতে পারছেন না এবং তাদের উদ্বেগ এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য যথাযথ চ্যানেলের অভাবের কারণে সরকারী পরিষেবাদি সম্পর্কিত তথ্য পাওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ, সময় এবং প্রচেষ্টা ব্যয় করতে হয়। এগুলির পাশাপাশি সামাজিক সমস্যাগুলির বিষয়ে কোনও কেন্দ্রীয় অভিযোগের ব্যবস্থা ছিল না, যা সমস্যাগুলি দ্রুত সমাধানে সহায়তা করতে পারে। এটি মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা জনাব সজীব আহমেদ ওয়াজেদের পরামর্শে এই পরিষেবা চালু করা হয়েছে ।


শিক্ষায় নারীদের শতভাগ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারীদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করা এবং রাজনীতিতে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য শেখ হাসিনার গৃহীত উদ্যোগ ও সাফল্য অভাবনীয়।


২০১৭-১৮ সালের অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ২৮ শতাংশ নারী উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল, ২০১৮-১৯ সালে তা ২৯.৬৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীর হার ৯৯.৪ শতাংশ। সরকার বিনামূল্যে ৬-১০ বছর বয়সী সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারছে। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয় এবং স্কুলে যেতে উৎসাহিত করতে মেয়েদের দেওয়া হয় বৃত্তি। সম্প্রতি সরকার ঘোষণা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হবে এবং শিক্ষার্থীরা এককালীন ২০০ টাকা পাবে স্কুলের পোশাক তৈরি করার জন্য।


নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে কোনও জামানত ছাড়াই সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা এসএমই ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আবার নারী উদ্যোক্তারা বাংলাদেশ ব্যাংক ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ১০ শতাংশ সুদে ঋণও নিতে পারছেন। বর্তমানে ৩০ লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক পোশাক শিল্পে কর্মরত আছেন। সরকারের সপ্তম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২০২০) অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের অঙ্গীকার করা হয়েছে।


এছাড়া ব্যবসায়ে সমান সুযোগ তৈরি করার উদ্দেশ্যে ২০১১ সালে জাতীয় নারী নীতি গ্রহণ করা হয়। দুস্থ, অসহায় ও পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য বর্তমান সরকারের বহুমুখী প্রকল্প চালু আছে; এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ভিজিএফ, ভিজিডি, দুস্থ ভাতা, মাতৃত্বকালীন ও গর্ভবতী মায়েদের ভাতা, অক্ষম মা ও তালাকপ্রাপ্তদের জন্য ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, আমার বাড়ি-আমার খামার ইত্যাদি। এছাড়া কর্মজীবনে নারীদের অংশগ্রহণকে সহজ করার লক্ষ্যে মাতৃত্বকালীন ছুটি ৪ মাস থেকে ৬ মাসে উন্নীত করা হয়েছে। প্রান্তিক নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য খোলা হয়েছে গ্রামভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিকের; মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিমের আওতায় গর্ভধারণ থেকে প্রসবকালীন সব খরচ, এমনকি যাতায়াত খরচও এখন সরকার বহন করে। যার ফলে মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার এখন প্রতি লাখে ১৭০ জন।


ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সব আন্দোলন, সংগ্রাম ও দেশ গঠনে আমাদের নারীদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তাই রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণকে সুসংহত করার জন্য জাতীয় সংসদে নারী আসনের সংখ্যা আরও পাঁচটি বাড়িয়ে ৫০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক নারীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে ১২ হাজারের বেশি নারী জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়েছে। বর্তমান সংসদে নারী সদস্য আছেন ৭২ জন এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, শিক্ষামন্ত্রীসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের আসীন করা হয়েছে এবং তারা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।


নারীর প্রতি সব ধরনের সহিসংতা রোধে ২০১২ সালে প্রণয়ন করা হয় পারিবারিক সহিংসতা দমন ও নিরাপত্তা আইন ২০১২। নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে প্রণয়ন করা হয় মানবপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১১। বাল্যবিবাহ নিরোধ করে মেয়ে শিশুদের সমাজে অগ্রগামী করার জন্য বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া মেয়েশিশুদের নিরাপত্তায় শিশু আইন ২০১৩ প্রণীত হয়েছে। হিন্দু নারীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার্থে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে এবং ৭টি বিভাগে One stop crisis center খোলা হয়েছে।


ধর্ষণের আলামত সংগ্রহে ও পরীক্ষায় কিছু দিন আগেও Two finger test করা হতো, যা ধর্ষিতা নারীর প্রতি ছিল বৈষ্যমূলক ও অবমাননাকর। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই তা বাতিল করা হয়েছে। আশা করা যায় এরই ধারাবাহিকতায় অচিরেই Evidence Act 1872-এর ১৫৫ ধারা, যা ধর্ষিতা নারীর চরিত্র ও জীবনধারা নিয়ে প্রশ্ন করার এখতিয়ার প্রদান করে, সেই বৈষম্যমূলক, অমানবিক এবং নারীর প্রতি চরম অপমানসূচক ধারাটিকে শিগগিরই বাতিল করা হবে। এটি না হলে ধর্ষিতা নারীরা বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে আগ্রহী হবে না এবং নারীর প্রতি বৈষম্য দূর ও নিশ্চিত হবে না।

সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিতের অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আশা করা যায় এর আলোকে সংবিধানের ২৮(২) নং অনুচ্ছেদে যেখানে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’, তা সংশোধন করে ‘রাষ্ট্র, গণজীবন এবং পারিবারিক জীবনে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’ এই প্রত্যয় আমাদের মহান সংবিধানে সংযোজন করা হবে। পারিবারিক পরিমণ্ডলে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে নারীকে পূর্ণভাবে স্বাবলম্বী করা বা সামাজিক ও গণজীবনে নারীর শতভাগ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা বাধাগ্রস্ত হবে।

নারী-পুরুষের সমতা অনুধাবনের অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতায় নারী-পুরুষের আনুপাতিক অবস্থান। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণের বিষয় বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। আবার ১৩৬টি দেশের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্য নিরসনে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম, যা গত ১০ বছরে এগিয়েছে ১১ ধাপ (Global Gender Group Report 2013, World Economic Forum)। নারীরা তাদের মেধা, শ্রম, সাহসিকতা, শিক্ষা ও নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের দেশ গঠনে কাজ করে যাচ্ছেন এবং একই সঙ্গে ভূমিকা রাখছেন একটি স্বাবলম্বী শিক্ষিত প্রজন্ম গঠনে। নানা অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে যে অভাবনীয় আর্থিক সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও প্রবৃব্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে, তা মূলত নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতির জন্যই, আর এক্ষেত্রে যার অবদান অনস্বীকার্য, তিনি রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি গ্লোবাল উইমেন্স লিডারশিপ, প্ল্যানেট ফিফটি ফিফটি চ্যাম্পিয়ন, এজেন্ট অব চেঞ্জসহ নানাবিধ সম্মাননা অর্জন করেছেন। তার সব অর্জন বাংলাদেশের নারীদের যেমন গর্বিত করে, তেমনি আশার আলো দেখায় পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বৈষম্যহীন-সম্মানজনক অবস্থানে উন্নীত হয়ে দেশ গঠনে অংশগ্রহণে।